বিশ্বায়নের অভিঘাতে কিছু পুরোনো সংকটের সমাধান হলেও নতুন নতুন সংকট সামনে আসছে। তাতে নৈতিকতাসম্পর্কিত আলোচনা আবার নতুন মাত্রা নিয়ে শুরু হয়েছে। নৈতিকতা কী, এর আবশ্যক ভিত্তি, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে নৈতিকতা কতটা অপরিহার্য, এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। দেখা যাচ্ছে, সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক বিচ্যুতির একটি যোগসূত্র আছে। তাই নৈতিকতার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের নৈতিক জাগরণ অপরিহার্য।
বাঙালি জীবনের বিভিন্ন সংকট-মুহূর্তেও চিন্তাশীল মানুষেরা নৈতিকতা নিয়ে আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এখন প্রায় সবার কাছেই, সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা চর্চার প্রয়োজন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই নানা সংকটে জর্জরিত। রাজনৈতিক অবিশ্বাস, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয়, আর্থিক সন্ত্রাস, সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক হয়ে যেতে পারে। ফলে সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাতীয়ভাবে নৈতিকতার পুনরুজ্জীবন নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত মানুষেরা অগ্রসর হতে চেয়েছে। লক্ষ্য ছিল সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ। যেখানে সৎ ও যোগ্য মানুষ পাবেন তাঁর প্রাপ্য স্থান। দারিদ্র্যমুক্ত ও মানবিক সমাজ নির্মিত হবে। মানুষ ভেদাভেদ ভুলে সুশাসনে প্রীত হবে। অথচ প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেনি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি। জাতি প্রত্যাশিত গন্তব্য থেকে এখন অনেক দূরে। মানবিকতাশূন্য নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। নেশায় আসক্তি, লাভ ও লোভের সীমাহীন স্বার্থান্ধ হিসাব, দেশপ্রেমহীন জীবনাচরণ এবং দেশমাতৃকাকে অবহেলা ও উপেক্ষা করে সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দেশত্যাগের প্রবণতাও প্রবল হয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব বা কর্তব্য, তা পালন করা হচ্ছে না। কিন্তু কেনো আমরা এমন ভাঙনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম? উত্তর, আমরা নৈতিকভাবে কাম্য সুদৃঢ় অবস্থানে নেই। আমরা কল্যাণ ও সুন্দরের সাধনায় নিবেদিত নই। আমরা শ্রেয়র ভাবনায় যথার্থ মনোযোগী হইনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।
আমরা মনে করি কেবল পাঠ্যপুস্তক ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় কোনোভাবেই সৎ, দেশপ্রেমিক ও উন্নত মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সনদনির্ভর চাকরিপ্রত্যাশী মানুষ সৃষ্টি সম্ভব হলেও তা দিয়ে জাতিকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অপর দিকে সর্বস্তরে দুর্নীতির কারণে দেশের সম্পদ নিঃশেষ হচ্ছে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশপ্রেমহীন কিছু ব্যক্তির প্রভাবে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথ ধরে এখন তার সামাজিকীকরণ ঘটছে। হতাশাগ্রস্ত তারুণ্য ধাবিত হচ্ছে বিভ্রান্তির পথে। সামাজিক ও সামষ্টিক ভাবনার পরিবর্তে ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাসম্পন্ন মানবিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, যা অধোগতিকে রোধ করতে পারে। এজন্য একটি সার্বিক ও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। এ আন্দোলন দেশকে উপহার দেবে একটি সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক নতুন প্রজন্ম।
পূর্বোক্ত সত্য স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, আমরা হতাশ নই। আমরা সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। মূল্যবোধের অভাবহেতু মুমূর্ষু মানবিকতা রক্ষা করার জন্য আমরা সংগ্রাম করতে চাই। আমরা নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে চাই। আমরা একটি প্রজন্ম নির্মাণ করতে চাই, যারা শ্রেয় মূল্যবোধসম্পন্ন হবে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা একটি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, সচেতন, সৎ, দেশপ্রেমিক ও মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই।
জাতীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এ সংকট আরও প্রকট হতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ কাজ সহজসাধ্য নয়। কঠিন, বিশাল ও দীর্ঘ সাধনালব্ধ এ কাজ করার মানসে আমরা গঠন করেছি এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ। দেশের সর্বস্তরে নৈতিকবোধসম্পন্ন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও অসাম্প্রদায়িক উচ্চ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং সমাজের সর্বত্র গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে এথিক্স ক্লাব বাংলাদেশ।