Website Launching Program
Ethics Club Bangladesh
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১ জানুয়ারি ২০১১
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”
ড. আতিউর রহমান
সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
বিস্তারিত
ড. আতিউর রহমান
সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
আজ দেশে কিংবা বিদেশে যেদিকে চোখ রাখি নৈতিকতার স্খলন চোখে পড়ে। নীতি আর অনীতির সীমারেখটা এতটাই সরু হয়ে গেছে যে আমরা অনেকেই এখন তার ব্যবধানটা অনুভব করতে পারি না। কেবল নিজেকে পরিশুদ্ধ রেখে সমাজে চলা কষ্টসাধ্য হয় যদি পুরো সমাজে সাধুতা হারিয়ে যায়। এই ভয়াবহ বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই অনুভব করেছেন। তাই বলেছেন,
“অন্যায় যে করে
আর অন্যায়
যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে
তৃণসম দহে।”
এক সময় সমাজ থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা নেওয়া হতো। অথচ আজ পারিবারিক সুশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও সমাজে বিদ্যমান নীতিহীন পরিবেশ ব্যক্তি জীবনের জন্যেও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবেেত্রই অনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। সংকটের তীব্রতা ভেদে নৈতিকতায় বিচূ্যতি ও তারতম্য হয়, এদের মধ্যে যোগসূত্র আছে। এক সময় সংকটের মধ্যেও সমাজ নৈতিকতার কাণ্ডারির ভূমিকা নিত।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
“আমরা যে হাজার বৎসরের বিপ্লবে, উৎপীড়নে, পরাধীনতায়, অধঃপতনের শেষ সীমায় তলাইয়া যাই নাই, এখনো যে আমাদের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে সাধুতা, ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে মনুষ্যত্বের উপকরণ রহিয়াছে, আমাদের আহারে সংযম এবং ব্যবহারে শীলতা প্রকাশ পাইতেছে, এখনো যে আমরা পদে পদে ত্যাগ স্বীকার করিতেছি, বহু দুঃখের ধনকে সকলের সঙ্গে ভাগ করিয়া ভোগ করাই শ্রেয় বলিয়া জানিতেছি, সাহেবের বেহারা সাত টাকা বেতনের তিন টাকা পেটে খাইযা চার টাকা বাড়ি পাঠাইতেছে, পনেরো টাকা বেতনের মুহুরি নিজে আধমরা হইয়া ছোটো ভাইকে কলেজে পড়াইতেছে – সে কেবল আমাদের প্রাচীন সমাজের জোরে।”
মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ যেমন শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্তমান বাণিজ্যিক প্রবণতা ও কাঠামোগত ত্রুটি সমাজের নৈতিক অবয় ত্বরান্বিত করছে। Political সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে এক করা। কিন্তু বর্তমানে সেই মহান আদর্শ কি রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে?
দুর্নীতির বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। এক সময় সমাজের হাতেগোনা অসাধু লোকদের চিহ্নিত করা হতো। সামাজিকভাবে তাদের হেয় দৃষ্টিতে দেখা হতো। আর বর্তমানে সমাজে তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এখন সমাজের সৎ লোক হাতে গোনা যায়। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রয়োজন রয়েছে। সুশিক্ষার মাধ্যমে এই মনোবদল বেশ খানিকটাই করা সম্ভব।
নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে শিক্ষার গুণগতমানের অবনমন ঘটেছে। ফলে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও নীতিহীনতা। শিক্ষার মানের তারতম্যের কারণে এক বাংলাদেশে কয়েক বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এই বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, আশা-আকাংখা ভিন্নতর হতে বাধ্য। গুণগতমানের নৈতিক ও আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চয় আসবে। কেটে যাবে সমাজের বিদ্যমান কূপমণ্ডুকতা।
নৈতিকতার এই অবয় থেকে উত্তরণে আমাদের মধ্যে নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে সততায় উদ্দীপ্ত করতে হবে। তাদের যথাযথ কর্মসংস্থান, নৈতিক শিক্ষা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, হতাশাগ্রস্ত তারুণ্য বিভ্রান্তির পথে চলে। তখন বৃহত্তর কল্যাণ ভাবনার পরিবর্তে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, ক্ষোভ আর অন্যায় বাসা বাঁধে। তাই প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ভারসাম্যপূর্ণ সাম্যভিত্তিক উন্নয়নের চেতনার চাবিকাঠিও ঐ একাত্তরের মনোভুমিতে স্থাপিত। তাই নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে অন্যায়, অবিচার, অনৈতিকতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে।
এক্ষেত্রে Ethics Club Bangladesh নেতৃত্ব দিতে পারে। আমি আশা করি আজ পহেলা জানুয়ারি Ethics Day উদযাপন এবং ক্লাবের ওয়েবসাইট উদ্বোধনের মাধ্যমে একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও সাম্যচিন্তার সমাজ প্রতিষ্ঠায় Ethics Club Bangladesh অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এই ক্লাবের যে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা আজ উপস্থাপন করা হলো তা আগামী প্রজন্মের জন্যে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি শিক্ষিত ও সৎ সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবে। আপনারা অনাবাসী বাংলাদেশীরা (NRB) যেভাবে আপনাদের বহু কষ্টে অর্জিত আয়/বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিতকে সুদৃঢ় করছেন, তেমনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নৈতিকতার মান উন্নয়নে যে পদক্ষেপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তার জন্যে আপনাদের সাধুবাদ জানাই।
বিজয়ের মাসে নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে প্রবাসী ভাইবোনদের এই অনন্য ভাবনা আমাকে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয়:
তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই,
বারে বারে নূতন লীলা তাই।
আবার তুমি জানি নে কোন্ বেশে
পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে,
আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে,
লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ. ৮৭)
"সমাজ উন্নয়নে সমাজর্কমীর ভূমিকা এবং কীভাবে একজন সমাজর্কমী হওয়া যায়"
এম ই চৌধুরী শামীম
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
স্কলারস বাংলাদেশ
বিস্তারিত
এম ই চৌধুরী শামীম
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
স্কলারস বাংলাদেশ
সমাজকর্ম কী ও কেন?
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বিকাশের সঙ্গে মানুষের বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজ অগ্রসর হলে ব্যক্তিও উন্নতি লাভ করে, আর সমাজ পিছিয়ে গেলে ব্যক্তিও পিছিয়ে পড়ে। এটি সাধারণ সত্য। কিন্তু দু-চার জনের ব্যক্তিগত উন্নতি হলেই যে সমাজের উন্নতি হয়েছে একথা বলা যায় না। সমাজের উন্নতি মানে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সার্বিক উন্নতি। কিন্ত সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নতি সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে না। সমাজ ও ব্যক্তির মাঝে এই হাত ধরাধরিটা বজায় রাখার জন্য অনেককেই কাজ করতে হয়। যারা কাজ করেন তাদেরকে সমাজকর্মী নামে অভিহিত করা হয়। অনেক কাল থেকেই সমাজে এরকম মানুষ আছে যাদেরকে মনে করা হয়, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। এই পরার্থে ব্যয়িত মানুষ আছে বলে সমাজ টিকে থাকে, অগ্রগতি লাভ করে।
একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, প্রত্যেক মানুষই সমাজের কাছে ঋণী। কারণ সমাজই মানুষকে মানুষে রূপান্তরিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সমাজবিযুক্ত ব্যক্তি কখনোই পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না। আমরা জানি মানুষের ক্রমবিকাশে পিতা-মাতা-শিক্ষক সহ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বর্তমান। যদি খুব সাধারণ অর্থেও বিচার করি, তাহলেও দেখা যায় যে, সমাজের প্রান্তিক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যন্ত সকল মানুষই মানুষের নির্মাণে সাহায্য করে। পৃথিবীর ইতিহাস, সমাজ-সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্যই দেয়।
যদি তাই ধ্রুব হয়, তাহলে মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে অবদান রাখতে হবে। এই অবদান রাখা মানুষের ঐতিহাসিক কর্তব্যের অংশ। আর সেজন্যই মানুষকে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজকর্মে অংশগ্রহণ করে সমাজ প্রগতির প্রবাহমান ধারায় যুক্ত থাকা নৈতিক দায়িত্ব। এ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবকে ম্লান করে।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব সোশাল ওয়ার্কারস (IFSW)-এর ওয়েবসাইটে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী:
‘সমাজকর্ম পেশা সামাজিক পরিবর্তন সাধন করে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করে এবং কল্যাণ অর্জনের জন্য মানুষকে মতায়ন ও স্বাধীনতা দান করে। মানবিক আচরণ ও সামাজিক পদ্ধতির উপাত্তগুলো ব্যবহার করে সমাজকর্ম মানবিক ক্রিয়া ও পরিবেশের মাঝে সন্ধি স্থাপনে সাহায্য করে। মানবাধিকারের নীতিমালা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজকর্মের মৌল ভিত্তি।’
সামাজিক উন্নয়নে সমাজকর্মীর ভূমিকা:
সমাজের প্রগতিতে সমাজকর্মীদের ভূমিকা বিরাট। বাঙ্গালি সমাজের দিকে যদি তাকাই, তবে দেখব এখানে সমাজকর্মের উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কালী প্রসন্ন সিংহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়ার মত বহু মনীষী নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি সমাজকর্মী হিসেবেও উজ্জ্বল হয়ে আছেন। মনীষীদের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, সমাজকর্মের প্রতি বাঙ্গালির নাড়ির টান আছে। আমরা দেখেছি সমাজ-রাষ্ট্রের যেকোন সংকটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা মানবিক বিপর্যয়ে মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে উত্তরণ হয়েছে সবসময়। ঔপনিবেশিক শানসামলের পূর্বে এ দেশে আশি হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। সেসব বিদ্যালয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি, তা ছিল সমাজের সম্পত্তি। বিদ্যাশিক্ষা তখন কেবল অর্থ উপার্জনের বিষয় ছিল না। শিক্ষকতা ছিল একটি ব্রত, নিছক জীবিকা অর্জনের পেশা নয়। শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের। সমাজে সবসময়ই কিছু মানুষ ছিল, যারা ব্রত হিসেবে সমাজকর্মে আত্মনিয়োগ করতো, তারা পেশা কী তা বুঝতো না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’ প্রবন্ধটিতে লিখেছেন, ‘রামমোহন রায়ের বন্ধু পাদ্রী এডাম সাহেব বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাতে দেখা যায় বাংলা-বিহারে এক লক্ষের উপর পাঠশালা ছিল, দেখা যায় প্রায় প্রতি গ্রামেই ছিল জনসাধারণকে অন্তত নূন্যতম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রায় তখনকার ধনী মাত্রেই আপন চণ্ডীমণ্ডপে সামাজিক কর্তব্যের অঙ্গরূপে পাঠশালা রাখতেন, গুরুমশায় বৃত্তি ও বাসা পেতেন তাঁরই কাছ থেকে।’
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন আমাদের দেশে বেশ বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু সেইসঙ্গে তা হয়েছে অনেকটাই বাণিজ্যিক। কিছুদিন পূর্বেও এ অবস্থা ছিল না। আমাদের চিকিৎসকরা ছিলেন মানবিক মানুষ। রাতবিরাতে তারা ধনী-গরীব নির্বিশেষে যেকোন অসুস্থ মানুষের বাড়িতে ছুটে যেতেন। চিকিৎসা করতেন শ্রেয় মানবিক মূল্যবোধ থেকে। বিনিময়মূল্য যেখানে গৌণ ছিল। মানুষের মনে তাদের জন্য তখন সম্মানের আসন ছিল। আর এ পেশার সঙ্গে এখন সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষীণ সম্পর্ক।
এক সময় এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নানা ধরনের ক্লাব, সংঘ ইত্যাদি ছিল। তারা সমাজে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে যুক্ত থাকতো। সাঁকো নির্মাণ, পাঠাগার তৈরি, দরিদ্র মানুষকে সহায়তা, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদি কাজ তারা করতো। এসব সংঘের সদস্যরা ছিল স্বেচ্ছাসেবী। বর্তমানে এসব ক্লাবের সংখ্যা কমে গেছে। যা আছে তার অনেকগুলোই কাঙ্খিত কাজ থেকে সরে গেছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে এসব সংগঠন কল্যাণমূলক নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।
দুর্যোগ কবলিত এদেশে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা সামাজিক ঐতিহ্য। কেউ সড়ক বা নদীপথে দুর্ঘটনায় পড়লে মানুষ নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতো। সে মানবিক ঐতিহ্যে এখন ফাটল ধরেছে। তারপরও বিপদগস্ত মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য এখনো কিছু টিকে আছে বলেই ঘনঘন বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েও এদেশের মানুষ উঠে দাঁড়ায়। তবে সতর্ক না হলে এই ধারাও যে কতদিন টিকে থাকবে তা বলা মুশকিল। দেশ ও সমাজের সর্বস্তরের কাছ থেকে এখনই উৎসাহ-উদ্দীপনা না পেলে হয়তো এ মানবিক ধারাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘ত্যাগস্বীকার মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু সেই ত্যাগে প্রবৃত্ত করাইবার উপলক্ষ কেবল কথার কথা হইলে চলে না; চাঁদার খাতা এবং অনুষ্ঠানপত্র আমাদের মন এবং অর্থে টান দিতে পারে না। যে জাতি আপনার ঘরের কাছে সত্যভাবে প্রত্যভাবে আত্মত্যাগের উপায় রচনা করিতে পারে নাই তাহার প্রাণ ক্ষুদ্র, তাহার লাভ সামান্য।’
আকবর আলী খান তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইতে লিখেছেন, ‘পরার্থপরতা শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জীবজন্তুর জগতেও এ ধরনের স্পৃহা দেখা যায়। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরার্থপরতা হল সে ধরনের আচরণ যা পালন করতে গিয়ে সমাজের একজন সদস্য ত্যাগের অথবা ঝুঁকির বিনিময়ে অন্যদের উপকৃত করে।’ তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘গরীবের ভালো করার ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়। এমনভাবে ভালো করতে হবে যাতে গরীবরা উপকৃত হয়। এ কাজ শুধু আবেগের ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা।’
সংগঠিত সমাজকর্ম বর্তমানে এনজিও রূপ লাভ করেছে। সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক ধরনের বেসরকারি সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এসব সংগঠনের কর্মীরা সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু অর্থলাভ এসব সংগঠন ও তার কর্মীদের মূল উদ্দেশ্য নয়। সমাজকল্যাণের কোন মহৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা কাজ করে থাকে। এনজিওরা কতটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো আর কতটা জনকল্যাণে কাজ করছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সামাজিক প্রগতিতে এদের ভূমিকা বিরাট। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতার মতো বিষবাষ্প থেকে সমাজকে মুক্ত করতে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এসব কাজ করতে গিয়ে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে তাদেরকে অনেক সময় লাঞ্ছনা-গঞ্জনারও শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসব প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মীদের ভূমিকা খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তাদের সরাসরি যোগাযোগ ও দৃঢ় নেটওয়ার্ক থাকার জন্য যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানলে দুর্যোগকবলিত এলাকায় দেশে ও বিদেশে সর্বত্র এনজিও কর্মীদেরকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় উন্নয়ন, উন্নয়নে জনঅংশগ্রহণ, তথ্য প্রযুক্তি, সংস্কৃতি চর্চা, অধিকার সচেতনতা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের যে গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে তা সরকারি বা বেসরকারি যে-কোন বড়মাপের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য খুবই সহায়ক।
কীভাবে একজন সমাজকর্মী হওয়া যায়
সমাজকর্ম বিজ্ঞান ও শিল্প দুই-ই। সমাজকর্মীরা যে-কোন সমাজের মূল্যবান সম্পদ। যে কেউ সমাজকর্মে অংশ নিতে পারেন। কারো যে বিষয়েই প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকুক না কেন এবং কোন ব্যক্তি যে পেশাতেই জীবিকা অর্জন করেন না কেন, সমাজকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ ও দায়িত্ব সবার। তবে একজন দক্ষ সমাজকর্মীর কিছু গুণ থাকতে হয় যা নিম্নরূপ:
একজন সমাজকর্মীকে অবশ্যই নৈতিকভাবে বলিষ্ঠ হতে হবে। সমাজের প্রতি তার স্বাভাবিক দায়বোধ থাকতে হবে। নিজ সমাজ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তার গভীর অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। বিভিন্ন সমাজ, জনগোষ্ঠী ও সামাজিক অগ্রগতি সম্পর্কে সাধারন ধারণা থাকতে হবে। ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। তার কাছে অর্থোপার্জনের চেয়ে সমাজ ও মানুষের কল্যাণ সাধন বড় হতে হবে। সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি তাকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং যেকোন মানুষের সঙ্গে তাকে স্বচ্ছন্দভাবে মিশতে হবে। কথার চেয়ে কাজকে বড় জানতে হবে। অন্যের মতামতের প্রতি তাকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, কারো মতকে তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সমাজকর্মীকে ধৈর্য্যশীল ও সহনশীল হতে হয়। লক্ষ্য নির্ধারণ, সমস্যা চিহ্নিত করা, অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়ন দ্বারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সিদ্ধান্ত যাচাই, প্রয়োগ, ফলাফল মূল্যায়ন ও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। সমাজকর্মী হয়ে উঠতে পরাপকারী মানসিকতা, সদিচ্ছা, কর্মনিষ্ঠা, সাহস, সততা, পঠন-পাঠন, হাতেকলমে শিক্ষা ও সমাজকর্মের অভিজ্ঞতা এসব কিছুই প্রয়োজন।
ফোরেন্স নাইটিঙ্গেল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রণদা প্রসাদ সাহা পর্যন্ত বহু মানুষ সমাজকর্মীদের আদর্শ। মাদার তেরেসার মতো অনেক সমাজকর্মী বিশ্বব্যাপী সম্মানের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশের ফজলে হাসান আবেদ ও নোবেলবিজয়ী মোহাম্মদ ইউনুস স্বদেশে পূর্ণ খ্যাতি না পেলেও সারা বিশ্বে সমাজকর্মী হিসেবে খ্যাতিমান। তবে নীরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন ও করছেন এমন সমাজকর্মীর সংখ্যাও পৃথিবীতে অসংখ্য। সমাজকর্ম কেবল সম্মানই এনে দেয় না, অনেক লাঞ্ছনা ও গঞ্জনাও উপহার দেয়। সমাজকর্মীকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় এবং তাকে সেজন্য মানসিকভাবে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয়।
আমরা দেখেছি, সমাজকর্মকে এখন অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য সমাজকর্ম শিখতে হয়। আধুনিক কালে সমাজকর্ম একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়। একজন পেশাদার সমাজকর্মীর দায়িত্ব অনেক বেশি। শুধু অর্থের মানদণ্ডে তাদের ভূমিকা নির্ণয় করা যায় না। তাদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা অনেক। এ ব্যাপারে কানাডিয়ান এসোসিয়েশন অব সোশাল ওয়ার্কার্স (CASW)-এর মতে:
‘সমাজকর্মীর জন্য ব্যক্তি ও পরিবেশের মধ্যেকার জটিল সম্পর্কের স্বচ্ছ ধারণা আবশ্যক। ব্যক্তিগত ঝোঁক ও পক্ষপাতিত্বকে উপেক্ষা করে সমাজকর্মের চর্চার মাধ্যমে অন্যের কল্যাণ সাধনে তারা সর্বদা প্রস্তুত। সমাজকর্মীদেরকে বলা হয় তারা যেন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। পেশাগত স্তরে তাদেরকে পেশাজীবী আচরণ ও সুস্পষ্ট আদর্শিক মতবাদ একত্রিত করে কাজ করতে হয়।’
তবে সমাজকর্মী হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা। এই ইচ্ছা করাটা সবার পক্ষেই সম্ভব। এরপর যারযার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের কল্যাণে কিছু কাজ করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। মানুষ হিসেবে মানুষের কল্যাণে কাজ করা প্রকৃত মানুষের কাজ। আর এ কাজ করলেই কেবল মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। নতুবা নয়।